ঈশ্বরচন্দ্রের 'বিদ্যাসাগর' উপাধির উৎস সন্ধানে
'বিদ্যাসাগর' ঈশ্বরচন্দ্রের নাম নয়, উপাধি। উপাধিটি দেশবাসীর দ্বারা এমনভাবে গৃহীত ও সমাদৃত হয়েছে যে, 'বিদ্যাসাগর' নামেই তিনি সমাধিক পরিচিত। এমন সার্থকনামা উপাধি তিনি কী কারণে কখন কোথা থেকে পেয়েছিলেন বা অর্জন করেছিলেন তা নিয়ে তাঁর জীবনীকার, ঐতিহাসিক বা গবেষকরা স্পষ্ট কোনো সদুত্তর দেননি।
উপাধিপ্রাপ্তি বিভিন্ন সূত্রে ঘটতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কিছু উপাধি দেওয়া হয়। বিদ্যাসাগরের জীবনীকার বা বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যাঁরা গবেষণামূলক গ্রন্থাদি রচনা করেছেন, তাঁরা মোটামুটি একমত যে, সংস্কৃত কলেজের অসাধারণ কৃতী ছাত্র হিসাবে তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকেই এই 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি পেয়েছিলেন। শ্রীরাধারমন মিত্র তাঁর 'কলিকাতায় বিদ্যাসাগর' প্রবন্ধে লিখেছেন, ---
"এই কলেজে (সংস্কৃত কলেজ) সর্বসাকুল্যে ১২ বছর ৫ মাস অধ্যয়নের পর ৪-১২-১৮৪১ তারিখে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজের নিকট হইতে একটি ও অধ্যাপকবর্গের নিকট হইতে আর-একটি মোট দুইখানি প্রশংসাপত্র এবং 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন।" (ঐতিহাসিক ২, জুলাই ১৯৭৮)।
সংস্কৃত কলেজে ইশ্বরচন্দ্র যে বিপুল বিদ্যা অধিগত করেছিলেন তার খতিয়ান নিতে গেলে সত্যি অবাক হয়ে যেতে হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বীরসিংহ গ্রামে পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে পিতার হাত ধরে যখন কলকাতায় চলে আসেন তখন বয়স কী-ই বা এমন। ১৮২৯ সালের ১লা জুন যখন তাঁকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হয় তখন তাঁর বয়স মাত্র ৯ বছর। সেখানে ১২ বছর ৫ মাস অধ্যয়ন করার পর তিনি ১৮৪১ সালে ৪ঠা ডিসেম্বর কলেজের পাঠ যখন সমাপ্ত করেন, তখন তাঁর বয়স ২১ বছর ৪ মাস। এর মধ্যে তিনি পড়েছেন ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলংকার, বেদান্ত, জ্যোতিষ, স্মৃতি এবং ন্যায়শাস্ত্র। কলেজে তিনি কখন কী বিষয় নিয়ে পড়েন, তার একটি সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র এইরকম ---
১৮২৯ সালের জুন থেকে প্রথম ৩ বছর ৬ মাস তিনি গঙ্গাধর তর্কবাগীশের কাছে ব্যাকরণ শাস্ত্রের পাঠ নেন। এ সময় তাঁর পাঠ্যতালিকায় ছিল 'মুগ্ধবোধ', 'অমরকোষ', 'ভট্টিকাব্য' প্রভৃতি। তারপর ১৮৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৩৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি প্রখ্যাত পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের কাছে পড়েন সাহিত্যশাস্ত্র। তাঁকে পড়তে হয় 'রঘুবংশ', 'কুমারসম্ভব', 'মেঘদূত', 'কিরাতার্জুনীয়', 'শিশুপালবধ', 'নৈষধচরিত', 'শকুন্তলা', 'বিক্রমোর্বশী', 'রত্নাবলী', 'মুদ্রারাক্ষস', 'উত্তররামচরিত', 'দশকুমার চরিত', 'কাদম্বরী' প্রভৃতি। সাহিত্যশাস্ত্রের পাঠ শেষ করে প্রবেশ করেন অলংকার শ্রেণিতে। সেখানে প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের কাছে এক বছর ধরে পড়েন সাহিত্যদর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রসগঙ্গাধর। তারপর ১৮৩৬ সালের মে মাস থেকে ১৮৩৮ সালে প্রথম ভাগ পর্যন্ত দু'বছর ঈশ্বরচন্দ্র শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির কাছে বেদান্ত শ্রেণিতে পড়েন। ১৮৩৮ সালে তিনি প্রবেশ করেন স্মৃতিশ্রেণিতে। সেখানে হরনাথ তর্কভূষণ ও হরচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে পড়েন 'মনুসংহিতা', 'মিতাক্ষরা', 'দায়ভাগ', 'দত্তকমীমাংসা', 'দত্তকচন্দ্রিকা', 'দায়তত্ত্ব', 'দায়ক্রমসংগ্রহ', 'ব্যবহারতত্ত্ব'। ১৮৩৯ সালে তিনি প্রবেশ করেন ন্যায়শ্রেণিতে। বিখ্যাত নৈয়ায়িক জয়নারায়ণ তর্করত্নের কাছে মুক্তাবলীসমেত ভাষাপরিচ্ছেদ, গৌতম সূত্র, নৈষধপূর্বভাগ প্রভৃতি অধিগত করেন। মধ্যে কিছুদিন জ্যোতিষ শ্রেণিতেও তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৮৪১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজের পাঠ শেষ করে বের হয়ে এলেন তখন তাঁর হাতে দুটি সার্টিফিকেট।
একটি সংস্কৃত কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট (ইংরেজি বয়ানে), আর একটি সংস্কৃত কলেজের গুণমুগ্ধ অধ্যাপকদের দেওয়া দেবনাগরী বয়ানে স্বেচ্ছাশংসাপত্র। এতে স্বাক্ষর করেছেন ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, ন্যায়, জ্যোতিষ ও ধর্মশাস্ত্রের ৭ জন অধ্যাপক। লেখা হয়েছে, 'অস্মাভিঃ শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরয় প্রশংসাপত্রং দীয়তে...'। অধ্যাপকদের কাছ থেকে এই স্বেচ্ছাশংসাপত্র আর কোনো ছাত্র পেয়েছিলেন কিনা আমাদের জানা নেই। এসব থেকে মনে হতে পারে এতগুলি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করার সুবাদেই তাঁকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা ঠিক নয়।
কেননা ১৮৩৯ সালের এপ্রিল মাসে ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দু ল' কমিটির পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় পাশ করলে আদালতে জজ পণ্ডিতের চাকরি পাওয়া যেতো। এ সময় তাঁকে যে সার্টিফিকেট দেওয়া হয় তাতে দেখা যায়, তাঁর নামের শেষে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহার করা হয়েছে। 'Issurchandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law.' সেই কারণে, বিনয় ঘোষ তাঁর 'বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ' (২য় খণ্ড) গ্রন্থে লিখেছেন, ---
"১৮৪১ সালে কলেজের পাঠ শেষ হবার পর অধ্যাপকরা মিলিত হয়ে তাঁকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি দিয়েছিলেন এ ধারণা প্রচলিত হলেও ঠিক নয়। 'বিদ্যাসাগর' উপাধি কলেজের অধ্যয়ন শেষ হবার অনেক আগেই তিনি পেয়েছিলেন। অন্তত ১৮৩৯ সালের মে মাসের আগে পেয়েছিলেন।"
ইন্দ্র মিত্র'র নথিপত্র সমৃদ্ধ গ্রন্থ 'করুনাসাগর বিদ্যাসাগর' বা ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠির 'Vidyasagar : The Traditional Moderniser' গ্রন্থও এ বিষয়ে বাড়তি কোনো আলোকপাত করেনি। অনুসন্ধান করতে গিয়ে শ্রীগোপিকামোহন ভট্টাচার্য প্রণীত 'কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস' (২য় খণ্ড, পৃ: ৩৭) গ্রন্থে এমন কিছু তথ্য পেলাম যা দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র উপাধি-প্রাপ্তির রহস্যটি ভেদ করা যায়। শ্রীভট্টাচার্য মহেশচন্দ্রের 'ন্যায়রত্ন' উপাধি-প্রাপ্তি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন, ---
"অবশ্য তখন সংস্কৃত কলেজ হইতেও 'ন্যায়রত্ন' হইতে ছাত্রগণ যে উপাধি লাভ করিতেন, তাহার তালিকা নিম্নে উদ্ধৃত হইল :
সাধারণ সাহিত্য : 'বিদ্যারত্ন', 'বিদ্যালঙ্কার', 'বিদ্যাসাগর', 'বিদ্যাভূষণ', 'বিদ্যাবিনোদ', 'বিদ্যানিধি', 'কবিরত্ন'।
হিন্দুদর্শন : 'ন্যায়রত্ন', 'ন্যায়ভূষণ', 'ন্যায়ালঙ্কার', 'তর্করত্ন', 'তর্কভূষণ', 'তর্কালঙ্কার', 'তর্কচূড়ামণি', 'তর্কবাচস্পতি', 'তর্কশিরোমণি', 'বেদান্তবাগীশ', 'তর্কপঞ্চানন', 'তর্কসিদ্ধান্ত', 'ন্যায়পঞ্চানন'।
স্মৃতিশাস্ত্র : 'স্মৃতিরত্ন', 'স্মৃতিচূড়ামণি', 'স্মৃতিশিরোমণি', 'স্মৃতিভূষণ', 'স্মৃতিকন্ঠ'।
বেদ : 'বেদরত্ন', 'বেদকণ্ঠ'।
কৃতীছাত্রগণ ইচ্ছামতো উপাধি বাছিয়া লইতেন। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ হইতে সংস্কৃত কলেজে উক্ত উপাধি অর্পণের রীতি প্রবর্ত্তিত হয়।"
সংস্কৃত কলেজের সাহিত্য শ্রেণির কৃতীছাত্র হিসাবে ১৮৩৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে অর্জন করেছিলেন 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি, এবং এই উপাধি তাঁর স্বনির্বাচিত।
¤ তথ্যঋণ :-
১) 'প্রসঙ্গ : বিদ্যাসাগর' (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯১)
★সম্পাদনা :- বিমান বসু।
★সংকলক :- শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়।
★প্রকাশনা সংস্থা :- 'বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি', ৭৪বি, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড, কলকাতা - ৭০০০১৬।
- আলোচক : সৌম্যদীপ মাইতি
- যোগাযোগ : ৬২৯০৩৭৭১৩৪
- S.L.S.T বাংলা অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে চাইলে ফোন করে যোগাযোগ করুন আমার ৬২৯০৩৭৭১৩৪ নম্বরে, অথবা আমার WhatssApp-তে ম্যাসেজ করুন ৮৭৬৮৮৩০২৩০ নম্বরে। ধন্যবাদ।
Post a Comment