NEW :
Loading contents...

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম ও শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম রচিত লাইন, প্রথম ও শেষ রচিত কবিতা, প্রথম রচিত ও প্রকাশিত এবং শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, প্রথম ও শেষ প্রকাশিত এবং তাঁর প্রথম অনূদিত ছোটোগল্প, প্রথম রচিত ও প্রকাশিত এবং শেষ প্রকাশিত উপন্যাস, প্রথম রচিত ও প্রকাশিত এবং শেষ প্রকাশিত নাটক, প্রথম ও শেষ প্রকাশিত প্রবন্ধ, প্রথম ও শেষ প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ, প্রথম প্রকাশিত সমালোচনা, নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনয়, প্রথম ও শেষ সম্পাদিত পত্রিকার তালিকা সাজিয়ে গুছিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসহকারে নিম্নে দেওয়া হল :–

  ¤ লাইন :-  

১) প্রথম রচিত লাইন :- 'মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে। / এখন তাহারা সুখেজলে ক্রীড়া করে।' শৈশবে রবি ঠাকুর দুষ্টুমি করছেন, তাঁকে একটু সামাল দেবার জন্য তাঁর মাস্টারমশাই বোর্ডে একটা ছড়া লিখে দিলেন --- 'রবি করে জ্বালাতন আছিল সবাই। বরষা ভরসা দিল তার ভয় নাই।' বললেন, লেখো তো তুমি এর পরে দুটি লাইন। কী আশ্চর্য, শিশু রবি ঠিক তখনই লিখে ফেললেন, --- 'মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে। / এখন তাহারা সুখেজলে ক্রীড়া করে।' এই কথাটি আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ 'জীবনস্মৃতি' (২৫ জুলাই ১৯১২/১৩১৯) থেকে জানতে পেরেছি। এই প্রবন্ধগ্রন্থে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের (১২৯৩ ব.) ১৭ নভেম্বর 'কড়ি ও কোমল' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনের ঘটনা এখানে বর্ণিত হয়েছে।

  ¤ কবিতা :-  

১) প্রথম মুদ্রিত কবিতা (বেনামে) :- 'অভিলাষ'  এটি একটি দীর্ঘ কবিতা। এই কবিতাটি প্রথমে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কবির বেনামে 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'য় প্রকাশিত হয়। শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাস এই কবিতাটি ১৭৯৬ শকাব্দের অগ্রহায়ণ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৮৭৪) সংখ্যা 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' থেকে উদ্ধার করে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যা 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কবিতাটিতে কবির নাম দেওয়া নেই, শুধু এটি 'দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত' বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাছে কবিতাটি উপস্থাপিত করলে তিনি এটি নিঃসংশয়ে তাঁর নিজের রচনা বলে স্বীকার করেছিলেন। এই কবিতাটির মধ্য দিয়েই তিনি সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। কবিতাটির প্রথম মুদ্রণকালে কবির বয়স ছিল ১৩ বছর ৭ মাস, এটি তার আরও এক বছর পূর্বের বা আগের রচনা। কবিতাটির স্তবক সংখ্যা - ৩৯টি এবং পঙ্‌ক্তি সংখ্যা - ১৫৬টি। এর প্রতিটি স্তবকে ৪টি করে পঙ্‌ক্তি আছে।

২) প্রথম মুদ্রিত স্বাক্ষরযুক্ত (স্বনামে) কবিতা :- 'হিন্দুমেলায় উপহার'আগেই বলেছি, 'অভিলাষ' কবিতাটিতে কবির নাম দেওয়া ছিল না। কিন্তু যে কবিতাটিতে সর্বপ্রথম কবির নামসংযুক্ত হয়ে বা স্বনামে সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়, সেটি হল 'হিন্দুমেলায় উপহার'। এই কবিতাটি প্রথমে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে পার্শী বাগানে অনুষ্ঠিত বার্ষিক হিন্দুমেলায় পঠিত হয় এবং ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি (১৪ ফাল্গুন ১২৮১ ব.) 'অমৃতবাজার পত্রিকা'য় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি বার্ষিক হিন্দুমেলা উৎসব উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন। এই কবিতাটি শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় 'অমৃতবাজার পত্রিকা'র পুরাতন ফাইল থেকে উদ্ধার করে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যা 'প্রবাসী' (পৃ. ৫৮০-৮১) পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত করেন। রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি' (২৫ জুলাই ১৯১২/১৩১৯) নামক আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধগ্রন্থে এর কোনো উল্লেখ নেই। কবির বয়স এই সময় ১৫ বছর নয়, --- মাত্র ১৩ বছর ৯ মাস। কবিতাটির স্তবক সংখ্যা - ২২টি এবং পঙ্‌ক্তি সংখ্যা - ৮৮টি। এর প্রতিটি স্তবকে ৪টি করে পঙ্‌ক্তি আছে। এই হিন্দুমেলায় কবি তাঁর রচনা নিয়ে সর্বপ্রথম সাধারণের সমক্ষে উপস্থিত হন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার 'The Indian Daily News' এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, --- "The Hindoo Mela." The Ninth Anniversary of the Hindoo mela was opened at 4 p. m. on Thursday, the 11th instant, at the well-known Parseebagan...on the Circular Road, by Rajah Komul Krishna, Bahadoor, the President of the National Society... Baboo Robindra Nath Tagore, the youngest son of Baboo Debendro Nath Tagore, a handsome lad of some 15, had composed a Bengali poem on Bharut (India) which he delivered from memory; the suavity of his tone, much pleased his audience. এই কবিতাটি প্রথমে 'হোক ভারতের জয়' নামে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে 'বান্ধব' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই কবিতাটি 'বান্ধব' পত্রিকায় প্রকাশের সময় সেখানে কবির কোনো নাম উল্লেখ ছিল না।

৩) শেষ (মৌখিকভাবে) রচিত কবিতা :- 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি' এই 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনা-জালে,/ হে ছলনাময়ী।' কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুশয্যায় তাঁর মৃত্যুর মাত্র আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচিত। কবিতাটির রচনাকাল : ৩০ জুলাই ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ। এই কবিতাটি তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ (মরণোত্তর প্রকাশিত) 'শেষ লেখা'র (১৯৪১/ভাদ্র ১৩৪৮) অন্তর্গত শেষ কবিতা।

৪) প্রথম অনূদিত কবিতা :- 'তীর্থযাত্রী' বিখ্যাত ইংরেজ কবি টমাস স্টেয়ার্ন্‌স (টি. এস.) এলিয়টের 'The Journey of the Magi' কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ 'তীর্থযাত্রী' নামে অনুবাদ করেন। এর আগে তিনি চিঠিপত্রের দু-এক ছত্র অনুবাদ করলেও পূর্ণাঙ্গ কবিতা এই প্রথম অনুবাদ করেছেন।

  ¤ কাব্যগ্রন্থ :-  

১) প্রথম রচিত কাব্যগ্রন্থ :- 'বনফুল' (প্রকাশকাল : ৯ মার্চ ১৮৮০/১২৮৬)। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কৈশোর পর্যায়' বা 'সূচনা পর্যায়' (১৮৭৮-১৮৮১ খ্রি.)-এর অন্তর্গত প্রথম কাব্য। এই কাব্যগ্রন্থটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। 'কবিকাহিনী' (১৮৭৮) কাব্যের দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে 'বনফুল' কাব্যটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলেও এই  কাব্যটি তার দুই বছর আগে রচিত ও মাসিকপত্রের পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। ১২৮২-৮৩ বঙ্গাব্দে (১৮৭৬ খ্রি) 'জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব' পত্রিকায় 'বনফুল' কাব্যের অষ্টম অর্থাৎ শেষ সর্গ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি তিনি লিখেছিলেন গ্রন্থাকারে প্রকাশের চার বছর পূর্বে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে; কবির বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর। কিন্তু কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সময় কবির বয়স ছিল ১৯ বছর। কাব্যটি মোট ৮টি সর্গে বিভক্ত।

২) প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :- 'কবিকাহিনী' (৫ নভেম্বর ১৮৭৮/সংবৎ ১৯৩৫)। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কৈশোর পর্যায়' বা 'সূচনা পর্যায়' (১৮৭৮-১৮৮১ খ্রি.)-এর অন্তর্গত দ্বিতীয় কাব্য। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি ১ম বর্ষের 'ভারতী' পত্রিকায় ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৮ খ্রি.) পৌষ-চৈত্র সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই সময় কবির বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দেই কবিতাগুলি নিয়ে 'কবিকাহিনী' কাব‌্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে গ্রন্থকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আরম্ভ হয়। এই কাব্যটির প্রকাশক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রবোধচন্দ্র ঘোষ। এই কাব্যগ্রন্থটি 'অমিত্রাক্ষর' ছন্দে রচিত। চার সর্গে রচিত এই কাব্যের নায়ক কবি এবং নায়িকা নলিনী। নলিনীর মৃত্যুর পর নায়ক কবির বিশ্রব্ধ প্রেমের উপলব্ধিতে কাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

৩) জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কাব্যগ্রন্থ :- 'জন্মদিনে' (১৯৪১/১ বৈশাখ ১৩৪৮)। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অন্তিম পর্যায়' বা 'গোধূলি পর্যায়' (১৯৩৮-১৯৪১)-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য কাব্য। এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা - ৩০টি। এই কাব্যের প্রথম কবিতা - 'অপরাহ্নে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে'। এই কাব্যের শেষ কবিতা - 'সৃষ্টিলীলাপ্রাঙ্গণের প্রান্তে দাঁড়াইয়া'। এই কাব্যের কবিতা সূচি :- 'অপরাহ্নে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে', 'আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি', আরবার ফিরে এল উৎসবের দিন', 'করিয়াছি বাণীর সাধনা', 'কাল প্রাতে মোর জন্মদিনে', 'কালের প্রবল আর্বতে প্রতিহত', 'জটিল সংসার', 'জন্মবাসের ঘটে', 'জীবনবহনভাগ্য নিত্য', 'আশীর্বাদে', 'জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে', 'তোমাদের জানি, তবু তোমরা যে দূরের মানুষ', 'দামামা ঐ বাজে', 'নদীর পালিত এই জীবন আমার', 'নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে', 'পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে', 'পোড়া বাড়ি, শূন্য দালান', 'ফুলদানি হতে একে একে', 'বয়স আমার বুঝি হয়তো তখন হবে বারো', 'বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে', 'বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি', 'বিশ্বধরণীর এই বিপুল কুলায়', 'মনে পড়ে, শৈলতটে তোমাদের নিভৃত কুটির', 'মনে ভাবিতেছি, যেন অসংখ্য ভাষার শব্দরাজি', 'মোর চেতনায়', 'রক্তমাখা দন্তপংক্তি হিংস্র সংগ্রামের', 'সেদিন আমার জন্মদিন', 'সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে', 'সিংহাসনতলচ্ছায়ে দূরে দূরদূরান্তে', 'সৃষ্টিলীলাপ্রাঙ্গণের প্রান্তে দাঁড়াইয়া'।

৪) শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ (মরণোত্তর) :- 'শেষ লেখা' (১৯৪১/ভাদ্র ১৩৪৮)। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অন্তিম পর্যায়' বা 'গোধূলি পর্যায়' (১৯৩৮-১৯৪১)-এর অন্তর্গত শেষ কাব্য। এই কাব্যের প্রকাশক হলেন শ্রীজগদিন্দ্র ভৌমিক। এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ কবি করে যেতে পারেন নি। কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করেছেন কবিপুত্র শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই গ্রন্থের 'বিজ্ঞপ্তি' অংশে তিনি লিখেছেন, --- "এই গ্রন্থের নামকরণ পিতৃদেব করিয়া যাইতে পারেন নাই। 'শেষ লেখা'র অধিকাংশ কবিতা গত সাত-আট মাসের মধ্যে রচিত। ইহার মধ্যে কয়েকটি তাঁহার স্বহস্তলিখিত, অনেকগুলি শয্যাশায়ী অবস্থায় মুখে মুখে রচিত, নিকটে যাঁহারা থাকিতেন তাঁহারা সেগুলি লিখিয়া লইতেন, পরে তিনি সেগুলি সংশোধন করিয়া মুদ্রণের অনুমতি দিতেন। 'সমুখে শান্তিপারাবার' গানটি 'ডাকঘর' নাটিকার অভিনয়ের জন্য লিখিত হইয়াছিল। গানটি পূজনীয় পিতৃদেবের দেহান্তের পর গীত হয়, তিনি এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন। তদনুসারে ইহা তাঁহার পরলোকযাত্রার পর (২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮) সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতন-মন্দিরে ও ৩২শে শ্রাবণ শ্রাদ্ধবাসরে শান্তিনিকেতনে গীত হয়। ভ্রমক্রমে বিভিন্ন সাময়িক পত্রে 'সমুখে শান্তিপারাবার' গানটির ষষ্ঠ পঙ্‌ক্তিতে 'জ্যোতি ধ্রুবতারকার' স্থলে 'জ্যোতির ধ্রুবতারকা' পাঠ এবং 'দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে' কবিতাটির চতুর্থ পঙ্‌ক্তিতে 'কষ্টের বিকৃত ভান' স্থলে 'কষ্টের বিকৃত ভাল' পাঠ ছাপা হইয়াছে। প্রথম ভ্রমটি শ্রীনলিনীকান্ত সরকার সর্বপ্রথম অনুমান করেন ও এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 'বিবাহের পঞ্চম বরষে' কবিতাটি শ্রীমতী নন্দিতা দেবীর বিবাহের পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে রচিত। 'তব জন্মদিনের দানের উৎসবে' কবিতাটি শ্রীমতী নন্দিতা দেবীর জন্মদিন উপলক্ষে রচিত। 'দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে' কবিতাটি পিতৃদেব মুখে মুখে বলিয়াছিলেন এবং পরে সংশোধন করিয়া দিয়েছিলেন। 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি' কবিতাটিও এইরূপ মুখে মুখে রচিত, কিন্তু এটি সংশোধন করিবার অবসর ও সুযোগ তাঁহার হয় নাই।" এই কাব্যের প্রথম গান (কবিতা) - 'সমুখে শান্তিপারাবার' এবং শেষ কবিতা - 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি'। এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা - 'সমুখে শান্তিপারাবার' (গান), 'বিবাহের পঞ্চম বরষে', 'তব জন্মদিনের দানের উৎসবে', 'রূপনারানের কূলে' (১১ সংখ্যক কবিতা), 'দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে', 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি' ইত্যাদি। 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনা-জালে,/ হে ছলনাময়ী।' কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ (মৌখিকভাবে) রচিত কবিতা। এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যায় তাঁর মৃত্যুর মাত্র আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচিত। কবিতাটির রচনাকাল : ৩০ জুলাই ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ।

  ¤ ছোটোগল্প :-  

১) প্রথম প্রকাশিত ছোটোগল্প :- 'ভিখারিনী'। এই গল্পটি ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৭ খ্রি.) শ্রাবণ-ভাদ্র সংখ্যায় 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

২) জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ ছোটোগল্প :- 'প্রগতি-সংহার'। এই গল্পটি ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের (১৯৪১ খ্রি.) ৩ আশ্বিন শারদীয় 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় প্রকাশিত হয়। গল্পটির রচনাকাল : ১১-২১ জুন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ। এর পূর্বনাম - 'কাপুরুষ'।

৩) শেষ প্রকাশিত ছোটোগল্প (মরণোত্তর) :- 'মুসলমানীর গল্প'। এই গল্পটি ১৩৬২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায় 'ঋতুপত্র' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পটির রচনাকাল : ১৪-২৫ জুন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ।

৪) প্রথম অনূদিত ছোটোগল্প :- 'সুভা'। এই গল্পটি প্রথমে ১২৯৯ বঙ্গাব্দের (১৮৯২ খ্রি.) পৌষ সংখ্যায় 'সাধনা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই গল্পে লেখক আমাদের সামাজিক মনোরাজ্যের একটি নতুন দিগন্তআবিষ্কার করেছেন। মূক বালিকা সুভার বেদনা সংসারে কোথাও এতটুকু করুণা, সহানুভুতির স্পর্শ সিঞ্চিত হয়নি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা থেকে বঞ্চিত হয়ে সুভা প্রকৃতির কাছে আশ্রয় নেয়। নানা স্বার্থপরতা ও সমাজ-চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত মানুষ তাকে বুঝতে পারেনা। তাইতো সুভাকে বাদ দিয়ে তার স্বামীর পরিবারের লোকজন ভাষাবিশিষ্ট কন্যা বিবাহের জন্য সন্ধান করছে।

  ¤ উপন্যাস :-  

১) প্রথম রচিত উপন্যাস :- 'করুণা' (১৮৭৭-৭৮)। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথম উপন্যাস লেখার প্রথম চেষ্টা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কৃষ্ণকান্তের উইল' উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্যায় যখন 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকার পাতা আলোকিত করছে সেইরকম একটা সময়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে তাঁর প্রথম উপন্যাস জন্য নিচ্ছে। মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসটি রচনা করেন। মাত্র ১৬-১৭ বছরের অপরিণত বালকের হাতের এই রচনা সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। ছোটো আকারের হলেও উপন্যাসটি পূর্ণাঙ্গরূপে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি প্রথমে ১২৮৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা থেকে ১২৮৫ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যা পর্যন্ত 'ভারতী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির বিষয়বস্তু রচনাকালের সমসাময়িক সময়ের। উপন্যাসে সমাজে নিপীড়িত হওয়ার ছবি ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের তিন নারী চরিত্র 'মোহিনী', 'করুণা' ও 'রজনী'র ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত 'মোহিনী' নামক যুবতী বিধবার সমস্যাকে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই উপন্যাসে এক বিধবা কিশোরীর বেদনাময় জীবনের কথা ফুটে উঠেছে। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব আছে। শিল্পরূপ অথবা চরিত্রচিত্রণ কোনোদিক থেকেই এটি উচ্চমানের রচনা নয় এবং রবীন্দ্রনাথ একে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন নি। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত 'রবীন্দ্র রচনাবলী'তে 'করুণা' নামে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চরিত্র - 'মহেন্দ্র', 'মোহিনী', 'করুণা', 'রজনী', 'নরেন্দ্র' প্রমুখ। ডঃ সুকুমার সেন এই উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছেন, --- " 'করুণা' অপরিণত রচনা হইলেও ঐতিহাসিক মূল্যবর্জিত নয়। মোহিনী মহেন্দ্রর অপ্রধান কাহিনির মধ্যে 'কৃষ্ণকান্তের উইলে'র ছায়া এবং 'চোখের বালি'র পূর্বাভাস আছে। করুণা, মহেন্দ্র ও রজনী পরে 'চোখের বালি'র মহেন্দ্র ও আশাতে পরিণত।"

২) প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস :- 'বউ-ঠাকুরাণীর হাট' (ইতিহাস ও রোমান্সনির্ভর উপন্যাস - ১১ জানুয়ারি ১৮৮৩/পৌষ ১২৮৯/ পৌষ ১৮০৪ শক)। এই উপন্যাসটি প্রথমে ১২৮৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা পর্যন্ত 'ভারতী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। উপমোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। রাজা প্রতিপাদিত্যের সঙ্গে মোগলদের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসটি লিখিত। উপন্যাসটি তিনি শ্রীমতি সৌদামিনী দেবীকে উৎসর্গ করেন। তিনি এই উপন্যাসে মানুষের শক্তিমত্তার বিপরীত মেরুতে সুকোমল হৃদয়বৃত্তি, প্রেম, মমতা প্রভৃতিকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দিয়েছেন। উপন্যাসটির পরিচ্ছেদ সংখ্যা - ৩৭টি। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসটি লিখতে প্রধানত প্রতাপচন্দ্র ঘোষের 'বঙ্গাধিপ পরাজয়' (প্রথম খণ্ড : ১৮৭৪) নামক গবেষণামূলক গ্রন্থ বা উপন্যাসের সাহায্য নিয়েছিলেন। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রভাব আছে। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, --- " 'বৌ-ঠাকুরাণীর হাট' ও 'রাজর্ষি' এই দুইটি উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রের ছত্র-ছায়ায় বসিয়া লিখিত।" এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চরিত্র - 'প্রতাপাদিত্য', 'বসন্ত রায়', 'বিভা', 'উদয়াদিত্য' প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের পিতৃবন্ধু শ্রীকণ্ঠ সিংহের ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটেছে 'বসন্ত রায়' চরিত্রে। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, --- "চরিত্রগুলির মধ্যে যেটুকু জীবনের লক্ষ্মণ প্রকাশ পেয়েছে সেটা পুতুলের ধর্ম ছাড়িয়ে উঠতে পারে নি। তারা আপন চরিত্র বলে অনিবার্য পরিণামে চালিত নয়, তারা সাজানো জিনিস একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে।" এর কাহিনি অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ 'প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০৯/১৩১৬) নাটক রচনা করেন। 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকটি পরে 'পরিত্রাণ' নামে পুনর্লিখিত হয়।

৩) শেষ প্রকাশিত উপন্যাস :- 'চার অধ্যায়' (রাজনৈতিক ও সমাজনীতি বা স্বদেশচেতনামূলক চেতনাশ্রয়ী উপন্যাস - ২২ ডিসেম্বর ১৯৩৪/অগ্রহায়ণ ১৩৪১)। রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাসটি কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত না হয়ে একদম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি ভূমিকা ও চারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সশস্ত্র বিপ্লববাদের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়। উগ্র স্বাদেশিকতার লোলুপ মূর্তি এখানে পরিস্ফুট। এটি সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি বিয়োগান্তক প্রেমের রাজনৈতিক উপন্যাস।   এই উপন্যাসের কাহিনির প্রাথমিক খসড়া যে সিংহল ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের প্রথম দিকেই তৈরি করে ফেলেছিলেন সে কথা আমরা জানতে পারি কবির ভ্রমণসঙ্গিনী শ্রীমতি রানী চন্দের স্মৃতিকথা থেকে। উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে 'lyric in prose'। রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে' (১৯১৬/১৩২৩) উপন্যাসের সঙ্গে এই উপন্যাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই উপন্যাসটিকে 'লিরিকের তোড়া' বলেছেন। এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চরিত্র - 'অতীন্দ্র', 'এলা', 'ইন্দ্রনাথ', 'সুরেশ', 'মাধবী', 'অখিল', 'বটু', 'কানাই' প্রমুখ। উপন্যাসটির নাট্যরূপ মঞ্চায়ন করেছিলেন উৎপল দত্ত। কবি অমিয় চক্রবর্তী 'The Four Chapter' নামে উপন্যাসটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এছাড়া সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরও একই নামে উপন্যাসটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

  ¤ নাটক :-  

১) প্রথম রচিত নাটক :- 'রুদ্রচণ্ড' (নাটিকা বা কাব্যনাট্য - প্রকাশকাল : ২৫ জুন ১৮৮১/১৮০৩ শক)। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাত্র ১২ বছর বয়সে বোলপুরে লেখা কাব্যগ্রন্থ 'পৃথ্বীরাজ পরাজয়' (১৮৭৩)-এর নাট্যরূপ; কাব্যটি লুপ্ত। এই নাটিকা বা কাব্যনাট্যটি মোট ১৪টি দৃশ্যে বিন্যস্ত। এই নাটকে মোট পথের দৃশ্য আছে - ৫টি। প্রতিহিংসা ও প্রেমের দ্বন্দ্ব এতে পরিলক্ষিত হয়। নাটকটি তিনি তাঁর দাদা শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুকে উৎসর্গ করেন। এই নাটকের প্রধান চরিত্রগুলি হল - 'রুদ্রচণ্ড', 'অমিয়া', 'চাঁদ কবি', 'দূত', 'দ্বাররক্ষক', 'পান্থ', 'সেনাপতি', 'দ্বিতীয় সেনাপতি', 'সৈন্যগণ', 'নাগরিকগণ' (৪ জন)।

২) প্রথম প্রকাশিত নাটক :- 'বাল্মীকি প্রতিভা' (গীতিনাট্য - ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১/ফাল্গুন ১৩০২ শক)। বিহারীলাল চক্রবর্তীর 'সারদামঙ্গল' (২৯ ডিসেম্বর ১৮৭৯/১২৮৬) কাব্যে বাল্মীকি মুণি দেবী লক্ষ্মীর অনুগ্রহ না নিয়ে দেবী সরস্বতীর কৃপাকে শিরোধার্য করেছেন এবং সেই সঙ্গে তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিয়ানো বাদনের সুরকে কথায় বেঁধে রাখতে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকটি রচনা করেন। একেবারে নিজের লেখা নাটকে এবং নিজের পরিচালনায় অভিনেতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম নাট্যমঞ্চে সাধারণের সমক্ষে আসতে দেখা যায় তাঁর মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রকাশিত 'বাল্মীকি প্রতিভা' নাটকে। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তাঁর ২৫ ও ২৯ বছর বয়সে আরো দু'বার তিনি এই নাটকে 'বাল্মীকি' চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। নিজের লেখা নাটকে অভিনয়ের আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনয়ের জন্য নাট্যমঞ্চে মোট তিনবার নামেন। তাঁর 'কালমৃগয়া' (৫ ডিসেম্বর ১৮৮২/অগ্রহায়ণ ১২৮৯) নামক গীতিনাট্যের অনেক গান 'বাল্মীকি প্রতিভা' নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণে সংযুক্ত হয়েছিল।

৩) শেষ প্রকাশিত নাটক :- 'শ্যামা' (নৃত্যনাট্য - ১৯৩৯/ভাদ্র ১৩৪৬)। এই নাটকের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র -- 'বজ্রসেন', 'শ্যামা', 'বন্ধু', 'কোটাল', 'সখীরা', 'উত্তীয়', 'সহচরী', 'পল্লীরমণীরা', 'প্রহরীগণ', 'নেপথ্যে' প্রমুখ।

  ¤ প্রবন্ধ :-  

১) প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ :- 'ভুবনমোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী'। এই প্রবন্ধটি ১২৮৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায় 'জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটি আসলে তিনজন কবির তিনটি কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা। এর মধ্যে 'ভুবনমোহিনী প্রতিভা' নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'ভুবনমোহিনী দেবী' ছদ্মনামে লেখা কাব্যগ্রন্থ, 'অবসর সরোজিনী' রাজকৃষ্ণ রায়ের লেখা কাব্যগ্রন্থ, 'দুঃখসঙ্গিনী' হরিশচন্দ্র নিয়োগীর লেখা কাব্যগ্রন্থ।

২) জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ প্রবন্ধ :- 'সভ্যতার সংকট' (অভিভাষণ - ১৯৪১/১ বৈশাখ ১৩৪৮)। এই অভিভাষণটি ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের (১৯৪১ খ্রি.) পয়লা বৈশাখ বীরভূমের বোলপুরের শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রজন্মোৎসব উপলক্ষ্যে পুস্তিকা আকারে বিতরণ করা হয়েছিল। এই আশি-বর্ষ্পূর্তি উৎসবই রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মোৎসব। নববর্ষের সায়াহ্নলগ্নে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে সমবেত আশ্রমবাসী ও অতিথি অভ্যাগতদের সমক্ষে পঠিত এই অভিভাষণই কবিজীবনের সর্বশেষ অভিভাষণ। কবির উপস্থিতিতে ক্ষিতিমোহন সেন সেদিন এই প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। সত্যদ্রষ্টা কবির বাস্তব জীবন-অভিজ্ঞতার শেষ স্বাক্ষর বহন করছে এই প্রবন্ধটি।

  ¤ প্রবন্ধগ্রন্থ :-  

১) প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ :- 'বিবিধ প্রসঙ্গ' (১৮৮৩/ভাদ্র ১৮০৫ শকাব্দ)। ই প্রবন্ধগ্রন্থটি আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে শ্রীকালিদাস চক্রবর্তী কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। এই প্রবন্ধগ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ - 'মনের বাগান বাড়ি' এবং শেষ প্রবন্ধ - 'সমাপন ও উৎসর্গ'। এছাড়া এছাড়া এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হল - 'বসন্ত ও বর্ষা', 'আদর্শ প্রেম', 'শূন্য', 'জমা খরচ', 'মনোগণিত', 'নৌকা', 'ফুল ফল', 'মাছ ধরা', 'ইচ্ছার দাম্ভিকতা', 'অভিনয়', 'আত্মসয় আত্মবিস্মৃতি', 'ছোট ভাব', 'অসংখ্য জগৎ', 'জগতের জমিদারী', 'প্রকৃতি পুরুষ', 'জগৎ-পীড়া' ইত্যাদি।

২) জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ প্রবন্ধগ্রন্থ :- 'আশ্রমের রূপ ও বিকাশ' (১৯৪১/আষাঢ় ১৩৪৮)। এই প্রবন্ধগ্রন্থটি 'বিশ্বভারতী পুস্তিকামালা'র অন্তর্গত হয়ে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের (১৯৪১ খ্রি.) আষাঢ় মাসে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম প্রবন্ধটি 'আশ্রমের শিক্ষা' নামে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় 'প্রবাসী' পত্রিকায় মুদ্রিত হয়, এবং 'নিউ এডুকেশন ফেলোশিপ' প্রকাশিত 'শিক্ষার ধারা' পুস্তিকার (১৩৪৩) অন্তর্গত হয়। রবীন্দ্রনাথের 'শিক্ষা' (১৭ নভেম্বর ১৯০৮) প্রবন্ধগ্রন্থের তৎপরবর্তী সংস্করণেও (১৩৫১ ব.) এই প্রবন্ধটি মদ্রিত হয়েছে। এর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি এই প্রবন্ধগ্রন্থের প্রথম প্রকাশিত ও তার কিছুকাল পূর্বে লিখিত। ১৩৪০ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত ও শান্তিনিকেতনে পঠিত 'আশ্রমবিদ্যালয়ের সূচনা' ইতিপূর্বে কোনো গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এটি 'আশ্রমের রূপ ও বিকাশ' পুস্তিকার বর্তমান সংস্করণে তৃতীয় প্রবন্ধরূপে মুদ্রিত হল।

৩) শেষ প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ (মরণোত্তর) :- 'সাহিত্যের স্বরূপ' (১৯৪৪/১ বৈশাখ ১৩৫০)। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংকলিত 'বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহে'র প্রথম গ্রন্থ। এই প্রবন্ধগ্রন্থে ১৩৪৪-৪৮ বঙ্গাব্দের মধ্যে রচিত ৯টি প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়েছে। অর্থাৎ এই প্রবন্ধগ্রন্থে ৯টি প্রবন্ধ আছে। সেগুলি হল -- 'সাহিত্যের স্বরূপ', 'কাব্যে গদ্যরীতি', 'কাব্য ও ছন্দ', 'গদ্যকাব্য', 'সাহিত্য-বিচার', 'সাহিত্যের মূল্য', 'সাহিত্যে চিত্রবিভাগ', 'সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা', 'সত্য ও বাস্তব'।

  • এইদিনেই এই প্রবন্ধগ্রন্থটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেকটি প্রবন্ধগ্রন্থ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সেটি হল -- 'আত্মপরিচয়' (১৯৪৪/১ বৈশাখ ১৩৫০)। এটি একটি আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ। এই গ্রন্থের শেষে ১৩১৭ বঙ্গাব্দে পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে লিখিত একটি সুদীর্ঘ পত্র সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

  ¤ সমালোচনা :-  

১) প্রথম প্রকাশিত সমালোচনা :- 'মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) 'ভারতী' পত্রিকায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা' করেন।

  • অনেক সমালোচক আবার ১২৮৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায় 'জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব' পত্রিকায় প্রকাশিত 'ভুবনমোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী' প্রবন্ধটিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সমালোচনা বলেছেন। কারণ এই এই প্রবন্ধটি আসলে তিনজন কবির তিনটি কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা। এর মধ্যে 'ভুবনমোহিনী প্রতিভা' নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'ভুবনমোহিনী দেবী' ছদ্মনামে লেখা কাব্যগ্রন্থ, 'অবসর সরোজিনী' রাজকৃষ্ণ রায়ের লেখা কাব্যগ্রন্থ, 'দুঃখসঙ্গিনী' হরিশচন্দ্র নিয়োগীর লেখা কাব্যগ্রন্থ। যদিও অনেক সমালোচনা প্রবন্ধের মধ্যে পড়ে তবুও এটি যেহেতু প্রবন্ধ হিসেবেই সবচেয়ে বেশি স্বীকৃতি পেয়েছে, তাই বেশিরভাগ সমালোচকের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সমালোচনা হল তাঁর মাত্র ষোলো বছর বয়সে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা'

 ¤ অভিনয় :- 

১) নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনয় :- 'এমন কর্ম্ম আর কর'ব না' (১৮৭৭ /আষাঢ় ১৭৯৯ শক) প্রহসনে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা জ‍্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'এমন কর্ম্ম আর কর'ব না' (১৮৭৭/আষাঢ় ১৭৯৯ শক) প্রহসনে নাট্যমঞ্চে প্রথম অবতীর্ণ হন বা নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনয় করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের পরবর্তী কোনো এক সময়ে তিনি এই প্রহসনে অভিনয় করেন। এই প্রহসনে রবীন্দ্রনাথ 'অলিকবাবু' চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। যা ঠাকুরবাড়ির লোকজন আর বন্ধুদের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে এই প্রহসনটির নাম পরিবর্তন করে 'অলীকবাবু' নাম রাখা হয়।

২) নিজের লেখা নাটকে নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনয় :- 'বাল্মীকি প্রতিভা' (২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১/ফাল্গুন ১৩০২ শক) গীতিনাট্যে। একেবারে নিজের লেখা নাটকে এবং নিজের পরিচালনায় অভিনেতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম নাট্যমঞ্চে সাধারণের সমক্ষে আসতে দেখা যায় তাঁর মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রকাশিত 'বাল্মীকি প্রতিভা' নাটকে। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তাঁর ২৫ ও ২৯ বছর বয়সে আরো দু'বার তিনি এই নাটকে 'বাল্মীকি' চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। নিজের লেখা নাটকে অভিনয়ের আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনয়ের জন্য নাট্যমঞ্চে মোট তিনবার নামেন। তাঁর 'কালমৃগয়া' (৫ ডিসেম্বর ১৮৮২/অগ্রহায়ণ ১২৮৯) নামক গীতিনাট্যের অনেক গান 'বাল্মীকি প্রতিভা' নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণে সংযুক্ত হয়েছিল।

  ¤ পত্রিকা :-  

১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা :- 'সাধনা'। ১৩০১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'সাধনা' পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 'সাধনা' পত্রিকাটির সম্পাদনার মাধ্যমেই পত্রিকা-সম্পাদকরূপে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ। ১৩০১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যা থেকে ১৩০২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকাটির ‌‌‌সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ছিন্নপত্রাবলী' গ্রন্থে 'সাধনা' পত্রিকাটির সম্বন্ধে লিখেছেন, – "সাধনা আমার হাতের কুঠারের মতো, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্যে একে আমি ফেলে রেখে মরচে পড়তে দেব না — এ'কে আমি বরাবর হাতে রেখে দেব।...." সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমল থেকেই পত্রিকাটি আর্থিক সংকটে ভুগছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। তিনি এই মাসিক পত্রিকাটিকে ত্রৈমাসিক করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন অবস্থার উন্নতি ঘটাতে। কিন্তু সেই চেষ্টাও ফলপ্রসু হয়নি। ১৩০২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনাতে পত্রিকাটির ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক মাসের যে যুগ্ম সংকলনটি বেরোয় সেটিই ছিল এই পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা।[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সাপ্তাহিক 'হিতবাদী' পত্রিকার সম্পাদক। --- যেহেতু 'হিতবাদী' (১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৮/১৮৯১) পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। তাই এই পত্রিকাটিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা বলে ধরা যাবে না। এই পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিই এই পত্রিকাটির নামকরণ করেছিলেন 'হিতবাদী'।]

২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত শেষ পত্রিকা :- 'বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি' (VISVA-BHARATI QUARTERLY)। বিশ্বভারতীর সঙ্গে দেশ-বিদেশের সম্বন্ধ রক্ষার তাগিদে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে (বৈশাখ ১৩৩০ ব.) প্রকাশিত হয় 'বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি' পত্রিকা। ত্রৈমাসিক এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৮২ পৃষ্ঠা আয়তনের প্রথম সংখ্যাটিতে মোট ৯টি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নিজেরই রচনা ছিল ৫টি। প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর নানান কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব তুলে দেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদনার ভার গ্রহন করলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শমতোই পত্রিকাটি পরিচালনা করতে থাকেন।

  ¤ আরও দেখুন :-  



  • আলোচক : সৌম্য মাইতি
  • যোগাযোগ : ৬২৯০৩৭৭১৩৪
  • S.L.S.T  বাংলা অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে চাইলে ফোন করে যোগাযোগ করুন আমার ৬২৯০৩৭৭১৩৪ নম্বরে, অথবা আমার WhatssApp-তে ম্যাসেজ করুন ৮৭৬৮৮৩০২৩০ নম্বরে। ধন্যবাদ।

This is a premium content, you can continue reading this content in our Android App. Click the button below to continue. alert-info

Post a Comment

Previous Post Next Post