চর্যাপদ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডেসক্রিপটিভ প্রশ্নোত্তর
১) চর্যাপদ ভারতের বাইরে বা নেপালে পাওয়া যাবার কারণ কী?
★উত্তর - চর্যাপদ ভারতের বাইরে বা নেপালে পাওয়া যাবার কারণগুলি হল ---
(ক) ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলার পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের আমলে চর্যাগীতির বিকাশ ঘটেছিল। পাল বংশের পরপরই বাংলাদেশে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যসংস্কার রাজধর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। অপরদিকে, বাংলার সেন রাজারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাই ধর্মীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত সেন সময়কালের কতিপয় হিন্দু ব্রাহ্মণ বৌদ্ধদের ওপর নিপীড়ন চালায়। সেন রাজাদের প্রতাপের কারণেই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অর্থাৎ বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছিল।
(খ) আবার, ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলায় আগমন ঘটলে মুসলিম তুর্কিদের আক্রমণের ভয়ে বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ প্রাণের ভয়ে পুথিপত্র নিয়ে নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে পালিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জীবনীকার সত্যজিৎ চৌধুরী লিখেছেন, --- "তুর্কি আক্রমণের সময়ে পুথিপত্র নিয়ে বাংলার পণ্ডিত মানুষেরা নেপালে, তিব্বতে চলে গিয়েছিলেন।" এ মতই সর্বাধিক মান্য।
(গ) চর্যা গবেষক তারাপদ মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, এক সময়ে নেপালে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলা লিপিতে পুথি লিখেছেন এবং তাই তিনি বলেছেন, --- "নেপালে বাংলা অক্ষরে বাঙালি লিপিকরের লেখা পুথির অস্তিত্ব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।''
২) 'চর্যা' শব্দের অর্থ কী? এ প্রসঙ্গে যথোপযুক্ত তথ্য দিন।
★উত্তর - 'চর্যা' শব্দের মূলত দু'টি অর্থ প্রাধান্য পায়। সেগুলি হল ---
(ক) 'চর্যা' শব্দের সাধারণ অর্থ আচার আচরণ। বিশেষ অর্থ -- মুনি ঋষি যোগী তপস্বীদের সুনির্দিষ্ট আচার আচরণ, -- তাঁদের থাকা, খাওয়া, পরা, কাজকর্ম, ধর্মাচরণ ইত্যাদি -- যেগুলি তাঁর শিষ্য পরম্পরায় মেনে চলেন। তাই চর্যা মানে -- দুষ্কর ব্রতাচরণ।
(খ) চর্যা মানে একশ্রেণির অধ্যাত্ম গীতি -- যাতে সাধু সন্ন্যাসীদের ব্রতাচরণ ও ধর্মকর্ম প্রকাশ পায়। এতে ২ বা ৩ জোড়া চরণ থাকে।
৩) চর্যার ভাষার প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক পটভূমি যে পশ্চিমবঙ্গ, তার কয়েকটি প্রমাণ দিন।
★উত্তর - তার কয়েকটি প্রমাণ নিম্নে দেওয়া হল ---
(ক) গৌণ কর্ম সম্প্রদানের বিভক্তির পরিবর্তে 'ক' বিভক্তির আপেক্ষিক প্রয়োগাধিক্য।
(খ) সাথে অনুসর্গের পরিবর্তে 'সন', 'সঙ্গ'-এর ব্যবহার।
(গ) ৩৯, ৪৯ নং পদ দুটি চর্যায় রূপকের ছলে পূর্ববঙ্গবাসীদের (বঙ্গাল) প্রতি অবজ্ঞা অনুকম্পা মিশ্রিত মনোভাব প্রকাশ।
৪) চর্যার কেমন পুথি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছেপেছিলেন?
★উত্তর - মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার যে পুথিটি ছেপেছিলেন, সেটি সম্পূর্ণ পুথি নয় -- খণ্ডিত পুথি। প্রাপ্ত পুথিটিতে মোট পাতার নম্বর আছে ১ থেকে ৬৯। তন্মধ্যে হরপ্রসাদ পাননি ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ এবং ৬৬ নং, মোট ৫টি পাতা। এছাড়া, ৬৯ পাতার পর, পুথিতে আর কত পাতা ছিল, তাও জানা যায়নি। আবার এই ৫টি পাতা হারিয়ে যাওয়ার জন্যেই, এই পাতাগুলিতে লেখা ২৩ নং গানের অর্ধেকটি এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং গান অর্থাৎ মোট ৩.৫টি গান বা পদ তিনি পাননি। তাই হরপ্রসাদের খণ্ডিত পুথিতে আছে মোট ৬৪টি পাতা, মোট ৪৬.৫টি গান বা পদ। আর আছে প্রতিটি গানের নীচে সংস্কৃত টীকা। অর্থাৎ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই ৬৪টি পাতা সম্বলিত এই ৪৬.৫টি গান বা পদ (টীকা সমেত) যা ছেপেছিলেন --- তারই নাম 'চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'।
৫) চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ দিন।
★উত্তর - চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ নিম্নে দেওয়া হল ---
(ক) চর্যার ভাষার অধিকাংশ শব্দরূপ বাংলার নিজস্ব শব্দরূপ। যেমন -- 'তরঙ্গেতে হরিণার খুর ণ দীসঅ', 'ঝাণে দিঠা', 'কুম্ভীরে খাঅ'।
(ক) চর্যায় ব্যবহৃত অধিকাংশ প্রবাদই বাংলার নিজস্ব প্রবাদ। যেমন -- 'অপণা মাংসে হরিণা বৈরী', 'জো ষো চৌর সোই সাধী', 'হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী'। পরবর্তীকালের বাংলা কাব্যে ও জীবনে এগুলি বহু ব্যবহৃত হয়েছে।
(গ) চর্যার যৌগিক ক্রিয়াগুলি বাংলার খাঁটি যৌগিক ক্রিয়া। যেমন -- 'টুটি গেলি' (পদ-৩৭), 'গুণিআ লেহুঁ' (পদ-১২), 'পুচ্ছিন্ন জাণ' (পদ-১), 'ধরণ ণ জাই' (পদ-২)।
(ঘ) চর্যায় নঞর্থক বাক্যাংশ ব্যবহারেও বাংলার নিজস্ব ব্যবহার দেখা যায়। যেমন -- 'ণ জাই' (পদ-২), 'ণ ভুলই' (পদ-১৫)।
৬) 'সন্ধ্যা'(সন্ধা) ভাষা কী? চর্যাগীতি থেকে এই ভাষার একটি উদাহরণ দিন।
★উত্তর - চর্যাপদের ভাষাকে কেউ কেউ 'সন্ধ্যা' (সন্ধা) ভাষা বলেছেন। এই ভাষা হল ---
(ক) গূঢ়ার্থ প্রতিপাদক একরকমের সাংকেতিক বচন। যার সাধারণভাবে একরকমের অর্থ হয় কিন্ত তার ভেতরের অর্থ হয় অন্যরকম।
(খ) এক একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যেই এই ভাষা চলতে থাকে। সেই গোষ্ঠীর লোকেরাই তার অর্থ বোঝে, অন্যেরা বোঝে না।
(গ) সাধারণত গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই এই ভাষা ব্যবহার হয়। যেমন -- "সোনে ভরিতী করুণা নাবী। রূপা থোই নাহিক ঠাবী।।" (পদ-৮)
- ব্যক্তিগত মতামত :- চর্যাপদের আবিষ্কারক ও সম্পাদক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর "হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা" (১৯১৬) গ্রন্থের ভূমিকায় 'সন্ধ্যা' (সন্ধা) ভাষা সম্পর্কে যেটা বলেছেন, সেটা প্রায় সবারই জানা। তাই এখানে উত্তরটা অন্যরকমভাবে একটু ঘুরিয়ে দেওয়া হল।
৭) চর্যাপদে কবিদের নামের সঙ্গে 'পাদ' বা 'পা' শব্দের যোগ থাকে কেন?
★উত্তর - 'পাদ' শব্দের অর্থ -- পূজনীয়, পূজ্যবাচী, গৌরব বাচক, যাঁর চরণ স্পর্শ করে শ্রদ্ধা জানানো যায়। 'পাদ' মানে ধর্মগুরু। সমকালে চর্যাকবিরা শিষ্য ভক্ত মণ্ডলীর কাছে পূজনীয় আচার্য বা গুরু হিসেবে মর্যাদা পেয়ে ছিলেন। তাই তাঁদের ভক্ত শিষ্যরা তাঁদের নামের সঙ্গে 'পাদ' বা 'পা' শব্দটি যোগ করে দিতেন। তদনুসারেই মুনিদত্ত টীকা রচনাকালে কবিদের নামের শেষে 'পাদ' বা 'পা' শব্দ যোগ করেছেন।
৮) চর্যাপদে ব্যক্তিগতভাবে কাহ্নপাদ বা কাহ্নপা কী ছিলেন? তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য লিখুন।
★উত্তর - ব্যক্তিগতভাবে কাহ্নপাদ বা কাহ্নপা ছিলেন সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধযোগী। তিনি ধর্মশাস্ত্র ও সঙ্গীত শাস্ত্র উভয় দিকেই দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য হল --- তাঁর পদগুলিতে নিপুণ কবিত্বশক্তি প্রকাশের পাশাপাশি তৎকালীন সমাজচিত্রও উদ্ঘাটিত হয়েছে।
৯) 'ভুসুক' নামকরণের কারণ কী? তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করুন।
★উত্তর - ভুসুক প্রথম দিকে অলস ছিলেন। ভুক্তি (ভু), সুপ্তি (সু), কুটিরে (কু) অবস্থান ছাড়া তিনি কিছু করতেন না বলে, তাঁকে ভুসুক বলা হয় বা তাঁর নাম ভুসুক রাখা হয়। তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য হল --- তাঁর পদগুলিতে বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
১০) 'তাড়ক' কি কবির প্রকৃত নাম না ছদ্মনাম? উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দিন।
★উত্তর - পণ্ডিতদের ধারণা -- 'তাড়ক' জনৈক চর্যা কবির প্রকৃত নাম নয় -- ছদ্মনাম। এর কারণ :-
(ক) 'তাড়ক' মানে ফাঁসুড়ে বা খুনি।
(খ) কেউ বলেছেন -- 'তাড়ক' মানে তাড়স্ক, অর্থাৎ কানের গয়না। সুতরাং, ফাঁসুড়ে বা গয়না -- এ রকম অর্থের শব্দটি (তাড়ক) কবির প্রকৃত নাম না-হওয়াই স্বাভাবিক।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য :- আপনাদের সবার সুবিধার জন্যই বা বেশি জানার জন্যই আমি এখানে ১ম টি উত্তরটিতে একটু বড় করে ৩টি পয়েন্ট দিয়েছি। এর মধ্যে শেষের পয়েন্টটি পরীক্ষার হলে আপনাদের লেখার দরকার নেই। এই পয়েন্টটি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র এই তথ্যটি আপনাদের সবার জানার জন্যই আমি এখানে দিয়েছি। আর ৫ নং উত্তরটিতে ছোট ছোট করে ৪টি পয়েন্ট দিয়েছি। কারণ ছাত্রছাত্রীরা ১০০% তথ্য কখনই মনে রাখতে পারে না। তারা বেশিরভাগই পরীক্ষার হলে ৭০%-৭৫% তথ্য মনে রাখতে পারে। তাই ছাত্রছাত্রীদের সবার সুবিধার জন্যই আমি এখানে কয়েকটি উত্তরে বেশি পয়েন্ট দিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু আপনারা পরীক্ষা হলে আপনাদের নির্দিষ্ট জায়গা আর সময়মতো ২-৩টি পয়েন্ট লিখবেন।
- আলোচক : সৌম্য মাইতি
- যোগাযোগ : ৬২৯০৩৭৭১৩৪
- S.L.S.T বাংলা অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে চাইলে ফোন করে যোগাযোগ করুন আমার ৬২৯০৩৭৭১৩৪ নম্বরে, অথবা আমার WhatssApp-তে ম্যাসেজ করুন ৮৭৬৮৮৩০২৩০ নম্বরে। এখানে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর মতো সঠিক তথ্যসহকারে ১ নম্বরের পাশাপাশি ২ নম্বরের ডেসক্রিপটিভ প্রশ্নোত্তরও করানো হয়। ধন্যবাদ।
দারুণ
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে।
DeleteKhub sundar post...
ReplyDeleteKhub sundor hoyeche
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে।
DeleteThank you
ReplyDeleteWelcome Apnake.
Deleteআপনার দেওয়া প্রত্যেকটা post ই খুব বড়ো মানের। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার 🙏🙏🙏🙏
ReplyDeleteস্বাগত আপনাকে।
DeleteThis comment has been removed by a blog administrator.
ReplyDeletePost a Comment